এবিএনএ : ভুয়া লাইক ঠেকাতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে ফেসবুক। বন্ধ করে দিচ্ছে ভুয়া ও সন্দেহজনক অ্যাকাউন্টগুলো। কিন্তু একদিকে যেমন ভুয়া অ্যাকাউন্ট বন্ধ হচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে ভুয়া অ্যাকাউন্ট থেকে দেওয়া লাইকের চাহিদা ও দাম হু হু করে বাড়ছে। এর আগে এক হাজার ভুয়া লাইক ২০-৩০ ডলারে বিক্রি হলেও এখন তা অনেক বেড়েছে। মার্কিন প্রযুক্তি বিশ্লেষকেরা বলছেন, এখন এক হাজার ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ মার্কিন ডলারে বিক্রি হচ্ছে।
ফেসবুকের প্রোটেক্ট অ্যান্ড কেয়ার টিমের কারিগরি কর্মসূচি ব্যবস্থাপক শবনম শেখ ১৩ এপ্রিল থেকে ভুয়া অ্যাকাউন্ট এবং ১৪ এপ্রিল থেকে স্প্যামারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেন। ১৩ এপ্রিল ভুয়া অ্যাকাউন্ট বন্ধের প্রথম পদক্ষেপেই ফ্রান্সের ৩০ হাজার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৪ এপ্রিল শবনম শেখ এক পোস্টে জানান, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরবসহ আরও কয়েকটি দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি স্প্যাম ফেসবুকে ছড়ানো হচ্ছে। এসব দেশ থেকে ভুয়া লাইক ও ভুয়া অ্যাকাউন্ট শনাক্ত করে বন্ধ করার কথা জানান তিনি। বাংলাদেশেও অনেক অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে যায়। তবে যাঁরা জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে আবেদন করেছেন তাঁদের অনেকেই অ্যাকাউন্ট ফেরত পেয়েছেন।
ভুয়া অ্যাকাউন্ট বন্ধে ফেসবুকের কঠোর পদক্ষেপের পরও কি তা বন্ধ হয়েছে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভুয়া অ্যাকাউন্ট বন্ধে ফেসবুকের এ পদক্ষেপ কয়েক কোটি মার্কিন ডলারের স্প্যাম খাতটির তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। বরং ফ্রান্সের নির্বাচনের আগে ভুয়া অ্যাকাউন্ট সন্দেহে অনেক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনাটিকে আরও আকর্ষণীয় সুযোগ হিসেবে নিয়েছে স্প্যামাররা। তাদের আরও বেশি ভুয়া (ইন-অথেনটিক) অ্যাকাউন্ট খুলতে উৎসাহিত করেছে। এর আগে যেখানে ব্ল্যাক মার্কেট বা কালোবাজারে এক হাজার ভুয়া অ্যাকাউন্টের দাম ছিল ২০ মার্কিন ডলার, তা এখন ১০ গুণ বেড়েছে।
নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্সের অধ্যাপক ড্যামন ম্যাকয় বলেন, ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট কিনতে আন্ডারগ্রাউন্ড বাজারে যদি খোঁজ নেন তবে এক হাজার অ্যাকাউন্ট কিনতে ৩০০ থেকে ৪০০ ডলার পর্যন্ত লাগছে। আর্থিক দিক থেকে হিসাব করলে ৩০ হাজার অ্যাকাউন্ট বন্ধের ঘটনাটি স্প্যামারদের যৎসামান্য দমাতে পেরেছে।
এনবিসি নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভুয়া সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট তৈরির ক্ষেত্রে শুরুতেই রাশিয়া ও ভারতের নাম চলে আসে। রাশিয়ায় প্রোগ্রাম বা সফটওয়্যার ব্যবহার করে ভুয়া অ্যাকাউন্ট বেশি করে তৈরি করা হয়। ভারতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শ্রমিক বা কর্মী কাজে লাগিয়ে ভুয়া অ্যাকাউন্ট তৈরির কাজ করে।
২০১৬ সালে মার্কিন নির্বাচনের সময় ভুয়া খবর ছড়ানোয় ভূমিকা রাখার অভিযোগে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে ফেসবুক। এবার ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে তাই সতর্ক হয়েছে ফেসবুক। ফেসবুকের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এখন সহজে ভুয়া অ্যাকাউন্ট শনাক্ত করতে উন্নত সফটওয়্যার তৈরি করেছে ফেসবুক। কনটেন্টের মূল্যায়ন ছাড়াই কার্যক্রমের ধরন দেখে ভুয়া অ্যাকাউন্ট শনাক্ত করতে পারে ফেসবুকের এ প্রোগ্রাম। একই কনটেন্ট বারবার পোস্ট করা ও বার্তা পাঠানোর হার বাড়ানোর বিষয়টি ধরতে পারে ফেসবুকের এ প্রোগ্রাম।
স্প্যাম ফার্ম
এনবিসি নিউজ ডটকমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের মতো দেশে ভুয়া অ্যাকাউন্ট তৈরির কাজে সস্তায় কর্মী পাওয়া যায় বলে এখান থেকে অনেক প্রতিষ্ঠান ভুয়া অ্যাকাউন্ট বিক্রি করে। রাশিয়ায় প্রোগ্রামাররা সফটওয়্যার ব্যবহার করে ভুয়া অ্যাকাউন্ট তৈরির কাজ করে। রাশিয়ার একটি অ্যাকাউন্ট বিক্রির ওয়েবসাইটে নিশ্চিত ই-মেইল ঠিকানাসহ ২০ হাজার টুইটার অ্যাকাউন্ট ৯০০ মার্কিন ডলারে বিক্রি হতে দেখা যায়।
স্প্যামাররাও এখন দিন দিন আরও দক্ষ হয়ে উঠছে। প্রতিটি ভুয়া অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে কীভাবে আরও বেশি অর্থ আয় করা যায় তার চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। সহজে ধরা যায় না, এমন কৌশল খাটিয়ে ভুয়া অ্যাকাউন্ট তৈরি করা হয়। এসব অ্যাকাউন্ট থেকে ভুয়া খবর ছড়িয়ে বিজ্ঞাপন থেকে আসা আয়ের মতো আয় করার কৌশল নিচ্ছে তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের পার্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইবার ফরেনসিক ল্যাবের পরিচালক মার্কাস রজার্স বলেন, স্প্যাম ছড়িয়ে যে ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব ফেলা হচ্ছে সেটিই এখন বড় উদ্বেগের বিষয়। যেকোনো নির্বাচনের সময় স্প্যামার বা ভুয়া খবর ছড়ানো ব্যক্তিদের কাছ থেকে ছড়ানো খবরটি উদ্বেগ তৈরি করছে। এর আগে মেইলের মাধ্যমে ছড়ানো ভুয়া ওষুধ বা প্রলোভনের মেইলগুলো এত বড় প্রভাব ফেলতে পারেনি।
নতুন রূপে ই-মেইল স্প্যাম
সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটগুলো স্প্যামারদের জন্য নতুন দিগন্ত খুলে দেওয়াতে ই-মেইলে আসা পুরোনো ধাঁচের স্প্যামের পরিমাণ কমেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ রজার্স। অবশ্য গবেষণায় দেখা গেছে, ই-মেইল স্প্যাম আবার নতুন লক্ষ্য নিয়ে ফিরে আসছে।
সিসকোর ২০১৭ সালের করা সাইবার নিরাপত্তা প্রতিবেদন অনুযায়ী, গবেষকেরা ই-মেইল স্প্যামের পুনরুত্থান দেখতে পেয়েছেন। ২০১০ সালের পর থেকে এবারই সর্বোচ্চ ই-মেইল স্প্যাম বাড়ার হার দেখা গেছে। এ ধরনের স্প্যামের অধিকাংশই বটনেট, ক্ষতিকর (ম্যালিসাস) সফটওয়্যার নিয়ন্ত্রিত কম্পিউটার নেটওয়ার্ক থেকে পাঠানো হয়।
সিসকোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখনকার স্প্যামাররা একক কোনো ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে আক্রমণ করার পরিবর্তে ব্যবসাকে লক্ষ্য করে আক্রমণ করছে। এ ধরনের আক্রমণ প্রচলিত ফিশিং স্ক্যাম বা চাতুরিপূর্ণ মেইলের মতোই হয়। বিশেষজ্ঞ ম্যাকয় বলেন, ফিশিং স্ক্যামের মাধ্যমে পরিচিত উৎস বা পরিচিতজনের ছদ্মবেশে স্প্যামাররা করপোরেট নির্বাহী বা কর্মকর্তাকে মেইল পাঠিয়ে অর্থ স্থানান্তরের জন্য বলে। অনেক সময় এ ধরনের অর্থ কোনো আন্তর্জাতিক ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে পাঠাতে বলে যেখান থেকে অর্থ উদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব।
অন্যান্য স্প্যামাররা এখন ‘গ্রে মার্কেট’ এর দিকে ঝুঁকছে বেশি। ভুয়া পণ্য বিক্রির পরিবর্তে পরীক্ষা করা হয়নি কিন্তু বৈধভাবে বিক্রি করা যায় এমন ধরনের বিভিন্ন হারবাল ওষুধ বিক্রির চেষ্টা করছে। তারা গ্রাহক আর্কষণে নানাভাবে প্রলোভন দেখাতে পারে।
ভুয়া লাইক পরিস্থিতি
গবেষকেরা জানিয়েছেন, এক হাজার ভুয়া ‘লাইক’ একটি ব্যাচ আকারে নির্দিষ্ট দামে বিভিন্ন ইন্টারনেট হ্যাকার ফোরামে বিক্রি হতে দেখা যায়। অনলাইনে যেসব তথ্যের আর্থিক মূল্য রয়েছে সব ধরনের তথ্যই হ্যাকার ফোরামগুলোতে বিক্রি হয়। কম্পিউটার থেকে চুরি করা ক্রেডিট কার্ডের নানা তথ্য বিক্রির পাশাপাশি এখন ভুয়া লাইক বিক্রির হিড়িক পড়ে গেছে। সত্যিকারের ক্রেডিট কার্ডের তথ্য চুরির চেয়ে ভুয়া অ্যাকাউন্ট তৈরি এখন বেশি লাভজনক। অনলাইন বিপণন বিশেষজ্ঞদের মতে, ইন্টারনেটে সাড়া ফেলার জন্য এবং ব্যবসা বিষয়ক পরিচিতি তৈরি করতে ভুয়া অ্যাকাউন্টের পেছনে বেশি অর্থ খরচ করছেন অনেকেই।
ফেসবুকে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুঁজে পেলে ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে তা জানিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ফেসবুকের কর্মকর্তারা।